সংস্কার প্রস্তাবের ওপর মতামত দিতে দ্বিতীয় দিনের মত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরে বিএনপি। রবিবার সকাল ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এ বৈঠক হয়। এর আগে গেল বৃহস্পতিবার দিনভর আলোচনার পর বৈঠক মূলতবি করা হয়েছিল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল এ বৈঠকে অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী পদে টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ থাকতে পারবেন না, তবে একবার বিরতি দিয়ে আবারও দায়িত্ব পালন করতে পারবেন—জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এমন প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
বিএনপির মতে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এ ছাড়া অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিল—এই চারটি ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে এমপিরা নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন এ রকম প্রস্তাব করেছে দলটি।
গতকাল রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলজি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংলাপে এই প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে মত ও দ্বিমতের বিষয়ে ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থা’ চায় বিএনপি। এ ছাড়া সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারে বিএনপি একমত হয়েছে।
দলটি জানিয়েছে, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করতে একমত বিএনপি। মৌলিক অধিকারে সব না এনে যা নিশ্চিত করার সামর্থ্য রয়েছে, ততটুকু করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বৃহস্পতিবার এই সংলাপ শুরু হয়। রবিবার দ্বিতীয় দফা বৈঠকে টানা প্রায় সাত ঘণ্টা আলোচনা হয়।
মঙ্গলবার তৃতীয় দফায় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। ওইদিন বিচার বিভাগের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হবে।
সংলাপে আলোচনার বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করছি। আলোচনা অব্যাহত আছে। মোটামুটি ভালো এগোচ্ছে। বেশ কিছু বিষয়ে আমরা কাছাকাছি এসেছি।
কিছু কিছু বিষয়ে দ্বিমতের কথা বলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বাকশালে বিশ্বাস করি না যে এমন কিছু করা হবে, যেটা মানতে সবাইকে বাধ্য হওয়া লাগবে। আমরা মনে করি, দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে যা সংগত, যা সর্বাপেক্ষা উত্তম, তেমন কিছুই হওয়া উচিত।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, লিডার অব দ্য হাউস কে হবে তা রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিষয়েও কমিশনের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে আমাদের। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ সদস্যসংখ্যা নিয়ে একমত বিএনপি, কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচিত হবে তা নিয়ে আলোচনা চলমান।
সালাহউদ্দিন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে বলেন, ৪৮ (৩) ধারার পর নতুন বিধান যুক্ত করে রাষ্ট্রপতিকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘এনসিসি বিষয়ে একমত নই, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা দায় হয়ে যাবে। কেয়ারটেকার ছাড়া নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার হয় না, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র জন্যই দেশের নির্বাচনব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কেয়ারটেকার রাখা প্রয়োজন।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বলেছি, নারীদের আসনসংখ্যা ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু বিদ্যমান পদ্ধতিতেই মনোনয়ন হবে, সেটা আমাদের প্রস্তাবে বলেছি। তবে এটা (নারী আসনসংখ্যা উন্নীত করা) আমরা বলেছি, নেক্সট পার্লামেন্ট গঠন করার পরে, যখন ৩০০ এমপি প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবে এবং সংসদে এসংক্রান্ত সংশোধনী গৃহীত হলে বর্তমানের ৫০ এবং আরো ৫০ নিয়ে যে ১০০ গঠিত হবে, সেই ৪০০ সদস্যের সংসদে বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করে কোন পদ্ধতিতে পরবর্তী সংসদে নারী আসনের নির্বাচনটা হবে, তখন সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। বর্তমানের জন্য বিদ্যমান পদ্ধতি আমরা সঠিক মনে করেছি। ভোটের ন্যূনতম বয়স ২১ বছরের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছি।’
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সব স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে বিরোধী দল থেকে নেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আমরা বলেছি, এটা বাস্তবসম্মত নয়। এটা সংসদের প্র্যাকটিস ও সংসদের ওপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে আমরা এভাবে একমত হয়েছি যে কিছু কিছু স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে, যেমন—পাবলিক আন্ডারটেকেন কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি—এজাতীয় কিছু কিছু কমিটি আমরা বিরোধী দলের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা যায় বলে জানিয়েছি।’
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সংস্কার আগামী নির্বাচিত সংসদে আলোচনা করে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা। এর আগে বৈঠকের শুরুতে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগকে বিএনপি সিরিয়াসলি সহযোগিতা করছে। আমরা সব বিষয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সিরিয়াসলি সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে সহযোগিতায় আছি।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে মনোনীত হবেন সে বিষয়ে বিএনপি দলের মধ্যে একমত হয়নি বলে জানান সালাহউদ্দিন। তবে বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কার্যকর কমিশন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একমত হয়েছে। তিনি বলেন, এটি সংবিধানে উল্লেখ না করে আইন করে প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, জেলা কমিশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং এটি আইন করে করা উচিত বলে দলটির অবস্থান।
কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল, একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। তবে বিএনপি এই প্রস্তাবে একমত নয় বলে জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁরা এই বিষয়টি ‘উন্মুক্ত’ রাখার প্রস্তাব করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিএনপি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদের বিষয়টি নেই। তবে কমিশন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের কথাগুলো যুক্ত করার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বিএনপি একমত হয়েছে।