রবিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এক সেমিনারে বক্তারা টেকসই শিল্প প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সংরক্ষণ ও দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করার লক্ষ্যে যৌক্তিক জ্বালানি মূল্য নীতি প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছেন।
বক্তারা গ্যাসের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও সরবরাহ বৃদ্ধি, কয়লা ও এলপিজি ভিত্তিক গ্যাস ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্প এলপিজি নির্মাণ, গভীর অফশোর ড্রিলিং ও টেকসই জ্বালানি সমাধান অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন।
বক্তারা আরও উল্লেখ করেছেন যে, শিল্প প্রতিযোগিতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশকে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও বিদ্যুৎ গ্রিড স্থিতিশীল করার কৌশলসহ মূল নীতিগত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।
তারা রবিবার রাজধানীর রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘পলিসি কনসিডারেশনস ইন এনার্জি এফোরডাবিলিটি এন্ড ইমপ্যাক্ট অন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপিটিটিভনেস’ শীর্ষক এক সেমিনারে এই অভিমত তুলে ধরেন। পলিসি এক্সচেঞ্জ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন ড. ইজাজ হোসেন বিশেষ বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন- নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিসিআই-এর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী, বিএসআরএম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির আলী হুসেন, এফআইসিসিআই’র সভাপতি ও ইউনিলিভারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার, ইউরোচ্যামের সভাপতি নুরিয়া লোপেজ, ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. মাসরুর রিয়াজ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন ও সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন। ইআরএফ-এর সভাপতি দৌলত আক্তার মালা স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, বিগত সরকারের গত ১৫ বছরে গ্যাস অনুসন্ধান, বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আসলে কিছুই করা হয়নি। তবে ভূতাত্ত্বিক ও জরিপ পরিচালনায় কিছুটা কাজ করা হয়েছে।
বাংলাদেশকে এখন ‘অনুসন্ধান না করার’ জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে উল্লেখ করে জালাল বলেন যে, ‘দেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যে এলএনজি সংগ্রহ কর হচ্ছে, কিন্তু বৃহৎ পরিসরে গ্যাস অনুসন্ধান করতে পারছে না।’
গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ভোলা থেকে ঢাকায় গ্যাস আনা সম্ভব হলে অন্তত পরবর্তী তিন বছরের জন্য তীব্র জ্বালানি সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, নেপালের সাথে বিদ্যুৎ বিনিময়ের পাশাপাশি চর ও উপকূলীয় এলাকার জমি ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দেশের জন্য লাভজনক হবে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান ও গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ প্রতিদিন হ্রাস পাচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশ এখন জ্বালানির ক্ষেত্রে আরও বেশি আমদানি নির্ভরশীল।
তিনি আরও গ্যাস অনুসন্ধান, অভ্যন্তরীণ গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি, কয়লা ও এলপিজি ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্প এলপিজি নির্মাণ ও গভীর সমুদ্র উপকূলীয় গ্যাস কূপ খননের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পূর্ববর্তী সরকার শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। বরং গত কয়েক বছর ধরে গ্যাস সংকট তীব্র ছিল।
তিনি বিইআরসিকে হঠাৎ করে জ্বালানি শুল্ক বৃদ্ধি না করে জ্বালানির যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের আহ্বান জানান।
জ্বালানির দাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল কার্যকর জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের জন্য উপায় অনুসন্ধানের আহ্বান জানান।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, জ্বালানি একটি শিল্পের জীবনরেখা। জ্বালানি না থাকলে কোনও শিল্প থাকবে না।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত বিদ্যমান শিল্পগুলোকে সফল ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার জন্য সহায়তা করা। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিদ্যমান শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির আলী হুসাইন বলেন, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করার জন্য এটি উপযুক্ত সময় নয়, কারণ এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তিনি জ্বালানির দাম ‘মিশ্র মূল্য’ হওয়ার পক্ষে মত দেন। শিল্পের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রতিযোগিতার বিষয়টি বিবেচনা করে তা বাড়ানো যাবে না।
জ্বালানি খরচের চ্যালেঞ্চ ব্যবসার বিকাশের পথে একটি বড় বাধা উল্লেখ করে এফআইসিসিআই সভাপতি জাভেদ আখতার টেকসই জ্বালানি সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
টেকসই জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত করার জন্য ড. মাসরুর রিয়াজ তার পাওয়ার-পয়েন্ট উপস্থাপনায় প্রভাব মূল্যায়ন, ক্রমশঃ মূল্য সমন্বয়, ক্যাপটিভ বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ, সিস্টেম লস হ্রাস, যৌক্তিক ও কার্যকর মূল্য নির্ধারণ, ন্যায্য ও অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত করা, জ্বালানি কৌশল তৈরি করা ও অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।