শনিবার

,

২২শে মার্চ, ২০২৫

ইউনেস্কোতে উদযাপিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজত জয়ন্তী

নিজস্ব প্রতিবেদক
ছবি: সংগৃহীত

বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে উদযাপিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজত জয়ন্তী। ভাষার বৈচিত্র্য ও সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে দুই দিনের এ বিশেষ অনুষ্ঠানে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় প্যারিসে অবস্থিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এ রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, যা ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সব সদস্যদেশে পালিত হয়ে আসছে।

রজত জয়ন্তীর মূল আলোচনা অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার হিসেবে ভার্চুয়ালি ভাষণ দেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ২০২৪ এর ছাত্র-গণ বিপ্লবের অনুপ্রেরণা ছিল ‘৫২’র ভাষা আন্দোলন। তিনি বলেন, মানুষের পরিচয়ের মূলই হলো মাতৃভাষা। সবাইকে নিজের মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাস, ভাষার শক্তির উপস্থাপনা, আমাদের ভাষা, এটি আপনাদের প্রত্যেককে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও তাদের অধিকার সম্পর্কে কথা বলতে বাধ্য করে। আমাদের বাংলাদেশে আমরা সামাজিক-সংস্কৃতির ভিন্নতাকে আমরা অন্তর থেকে লালন করি। কারণ আমাদের ভাষা এবং দেহ আমাদের ইতিহাসে আমাদের পরিচয়, বাংলাদেশে মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্য আমরা মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে এ বৈচিত্র্যকে সম্মান করে আসছি।

বৈচিত্র্যময় এবং বহুভাষিক শিক্ষা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি সাধারণীকরণের চেষ্টা করতে হবে, তেমনিভাবে সংলাপ এবং উদ্যোক্তাদের জন্য মাতৃভাষা প্রযুক্তি এখনই শুরু করতে হবে যাতে সমস্ত ভাষা এ স্থানটি খুঁজে পায় এবং এখানে একাডেমিকভাবে অবদান রাখতে পারে।

তিনি বলেন, এটা করতে ব্যর্থ হলে থ্রি জিরো তত্ত্ব ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবো না। কারণ, কাউকে পেছনে রেখে এগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে না।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোয় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি খন্দকার এম তালহা এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাফিজা সাইমা।

ইউনেস্কো সদর দপ্তরের মঞ্চে বাংলাদেশি শিল্পীদের পরিবেশনা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

শনিবার নিজের ফেসবুকে বাংলাদেশি শিল্পীদের পরিবেশনকালীন বেশকিছু ছবি পোস্ট করে তিনি তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। ফারুকী লিখেন,“অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া সব শিল্পীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। শূন্যের মহাজন, সেজান- পালাকারের ৫২ ফিচারিং ২৪, পারশা-টুনটুন বাউলের ঘোর লাগা ‘জাত গেলো’, পিংকি-পারশার গাওয়া বাংলাদেশর চার ভাষায় গাওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’ মুগ্ধ করেছে সবাইকে। বাংলাদেশকে ভিন্ন ভাবে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।”

এসময় তিনি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান নির্মাতা তানিম নুর এবং মিউজিশিয়ান জাহিদ নিরবের প্রতি।

২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে প্রখ্যাত গবেষক, লেখক, তাত্ত্বিক ও কমিউনিস্ট নেতা বদরুদ্দীন উমরের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়ে। এ বিষয়ে ফারুকী বলেন,“বদরুদ্দীন উমর যে সাংস্কৃতিক রাজনীতির কথা বলতেন, যে লেন্সে ফেলে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করতেন সেটা বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অলক্ষ্যে জ্বালানী দিয়েছে। ২৪-ও তার বাইরে না। ইউনেস্কোতে আমাদের গতকালকের কালচারাল ইভেন্ট শুরু হয়েছে উমর ভাইয়ের সাক্ষাৎকারের শট দিয়ে। খুবই ছোট্ট একটা ক্লিপ, কিন্তু একটা সিগনিফিক্যান্স আছে আমাদের কাছে। উমর ভাইদেরকে সাইডলাইন করে, যে ফেইক শিশুতোষ বুদ্ধিজীবিতা বাংলাদেশে মেইনস্ট্রিম করে তোলা হয়েছিলো এই পাপের ফল আমরা এক দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের মধ্য দিয়ে ভোগ করেছি। যাই হোক, স্মৃতি নাকি হারিয়ে যায়। সেটা যেনো না হারায় সেজন্য কালকের অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তোলা থাকলো এখানে।”

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের ভাষাবিদ, ভাষা বিশেষজ্ঞ এবং ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

দূতাবাসের হেড অব চ্যান্সারি ওয়ালিদ বিন কাশেমের পরিচালনায় সমাপনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অংশ নেন দূতাবাসের প্রতিরক্ষা সচিব ব্রিগেডিয়ার মিজানুর রহমান, কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মিজানুর রহমান।

অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারাসহ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি প্রেমীরা উপস্থিত ছিলেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি শিল্পীদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১৩টি দেশের শিল্পীরা মনোজ্ঞ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরেন।

এছাড়া গত ২৫ বছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষা-ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করা হয়।

ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী বর্তমান বিশ্বে অনুমানিক ৮৩২৪টি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার ভাষা বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে অনেক ভাষা দ্রুত গতিতে হারিয়ে যাচ্ছে।